Daily News BD Online

পরিবারেই হোক বৃদ্ধ পিতা মাতার আশ্রয়


মো. জুবাইল আকন্দ

আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করি তাদের মধ্যে আলাদা একটি সংস্কৃতি আছে, আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের বেশির ভাগ মানুষ নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই দেশের আতিথ্য দেখে ভিন্ন দেশের মানুষেরা অবাক হয়ে যান। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সরকারের প্রচেষ্টায় দিন দিন ভালো হচ্ছে, যেটা আমাদের জন্য শুভ সংবাদ। শিক্ষার মান এবং লেখাপড়া জানা ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। লেখাপড়া শেখার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের ছড়িয়ে দিচ্ছি। দেখা যাচ্ছে মা-বাবার একমাত্র সন্তান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে চাকরি করছেন অথবা দেশ ছেড়ে বিদেশ গিয়ে চাকরি করছেন।

চাকরিজীবী সন্তানদের কেউ কেউ আছেন যারা গ্রামে থাকা বৃদ্ধ মা-বাবার খবর নেওয়ার কথা ভুলে যান। অনেক মা-বাবার একমাত্র সন্তান বিদেশে চাকরি অথবা ব্যবসা করেন। এদের কেউ কেউ আছেন, যারা বিদেশি মেয়ে বিয়ে করেন। বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার কারণে তারা দেশে আসতে চান না। যে মা-বাবা এত কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন সেই ছেলেমেয়ে মা-বাবার বৃদ্ধ অবস্থায় পাশে থাকতে পারছে না। পড়ালেখা শেষ করে সে স্বাবলম্বী হয়। তারপর সংসার। এর মাঝে বাবা-মায়েরও বয়স কিন্তু বাড়তে থাকে, কমতে থাকে শরীরের শক্তি, অবলম্বন হয়ে পড়ে সন্তানেরা। সংসারের হাল ধরে সবার দায়িত্ব নেয় বাড়ির ছেলে। কিন্তু কিসের খেয়ালে অতীতের সব স্মৃতি বিলুপ্ত হতে থাকে ছেলের।

বর্তমান সমাজ-সংসারে দেখা গেছে, বৃদ্ধদের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ছেলে-সন্তানদের ঘর-সংসারে লেগে থাকে ভুল বোঝাবুঝি ও ঝগড়া-বিবাদ। ছেলের বউ তার শ্বশুর-শাশুড়িকে গ্রহণ করতে পারে না নিজের মা-বাবার মতো। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরাও হাঁপিয়ে ওঠে নিজেদের জীবিকার কর্মব্যস্ততায়। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণ করতেই বেচারা ছেলের দিনরাত একাকার। বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণহিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে। এসব সংস্থা মূলত বৃদ্ধ বয়সে যাদের সহায়-সম্বল নেই, তাদের মাথায় রেখেই কাজ পরিচালনা করে।

সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। ফলে বৃদ্ধরা তাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার তথা আশ্রয় এবং বাসস্থনের অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একটা সময় যৌথ পরিবারই ছিল বাঙালি সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি। নৈতিক মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারাই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতেন। বয়োজ্যেষ্ঠরাও পরম মমতায় আগলে রাখত পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার ফলে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সন্তানরা তাদের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। বাংলাদেশের মানুষের বয়সসীমা ৪০ বছর পার হওয়ার পর থেকে বার্ধক্যজনিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। সাধারণত এই সময়ে মানুষ হৃদরোগ, হাড়ের ক্ষয়সহ বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। নিজেদের কর্মক্ষমতা অনেক কমে যায়। যতই বয়স বাড়তে থাকে ততই মানুষের মধ্যে সুপ্ত বাসনা থাকে এটাই, তার ছেলেমেয়েরা যেন তার প্রতি যত্নশীল হয়।

একজন ৭০ বছরের মা অথবা বাবা তার ছেলেমেয়েদের নিয়েই বাকি দিনগুলো কাটাতে চান। জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। এই বয়স্ক মানুষগুলোর কেউ থাকছে পরিবারের সঙ্গে আবার কেউ থাকছে বৃদ্ধাশ্রমে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ অনেক বাড়াতে হবে। সন্তান হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব নিজের মা-বাবাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। যাদের পরিবারে শুধু একটি মেয়ে থাকে, সেই মেয়ের জামাতাকে অনুরোধ জানাব তারা তাদের স্ত্রীর মা-বাবাকেও বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনার দায়িত্ব নেবেন। সেবা করার মাধ্যমে আমাদের মঙ্গল হয়। আমরা আমাদের মা-বাবাকে ঠিকমতো শ্রদ্ধা করলে আমার ছেলেমেয়েরা তা শিখবে। আমরা যখন বৃদ্ধ হব আমার ছেলেমেয়েরা সেই শিক্ষা কাজে লাগাবে। তাই আসুন বৃদ্ধাশ্রমকে নিরুৎসাহিত করি। নিজের মা-বাবাকে নিজের সঙ্গে রাখার শতভাগ চেষ্টা করার মাধ্যমে আমরা সুন্দর একটি পারিবারিক জীবন গড়তে পারি।এবং প্রতৃক মা বাবা চান জীবনের শেষ সময় টুকু পরিবারের সাথে কাটাতে।

মো.জুবাইল আকন্দ
লেখক ও সাংবাদিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন