তাছকিয়া রহমান প্রতিভা, দেবীদ্বার (কুমিল্লা) থেকে :
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়নে অন্তত ৩০টি স্পটে ড্রেজার বসিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করছেন ড্রেজার ব্যবসায়ীরা। এতে হুমকিতে রয়েছে বাড়িঘরসহ অনেক ফসলি জমি।
তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মন্তব্য করে জানান, বিষয়টি মৌখিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানিয়েও কোনো সমাধান হয়নি।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (১৬ মে) দুপুরে উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের ওয়াহেদপুর ও এগারোগ্রাম বাজার এলাকায় ড্রেজার দিয়ে নদী ও ফসলি জমিকে পুকুর বানিয়ে বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়।
একই ইউনিয়নের ওয়াহেদপুর গ্রামের কৃষক আলী হোসেন জানান, ‘গত কয়েকদিন ধরে ওয়াহেদপুর কাজী বাড়ির কাজী খোরশেদ ড্রেজার মেসিন দিয়ে ওয়াহেদপুর পূর্বপাড়া বিলে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলনে ব্যবসা শুরু করছে। প্রশাসনের নিকট অভিযোগ করে লাভ নেই তাই অভিযোগ করিনি।’
ফাতেমা আক্তার নামে ৫০ বছর বয়সী এক নারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার জীবনকে জীবন মনে করি নাই, খেয়ে না খেয়ে, সন্তানদের মূখে ভালো খাবার না দিয়ে, নিজের অসুখে ঔষধ না খেয়ে, গার্মেন্টসে, তুলা কারখানায়, শহরের বাসা বাড়িতে, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঝি চাকরানির কাজ করে, পত্তনে জমি রেখে কিছু টাকা জমিয়েছি। জীবনের ৩০টি বছরের কষ্টের সঞ্চিত টাকায় সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে দেবীদ্বার উপজেলার ৪নং সুবিল ইউনিয়নের পশ্চিম মোখাড়া গ্রামে বাবার বাড়ির পাশে গত বছর ৩৩ শতাংশ জমি ১২ লক্ষ টাকায় কিনেছি। আমার সেই জমির পাশে ভূমি খেকু ফরিদ মিয়ার মৎস খামারে নজরুল মেম্বারের ড্রেজারের কারনে ধীরে ধীরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। গত দু’দিনে আমার জমির অনেক আংশ ওই ড্রেজারের গর্তে ভেঙ্গে পড়ে যায়। আমি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। আমার মতো অনেক কৃষক সর্বশান্ত হচ্ছে, আবাদী জমি ধ্বংস হচ্ছে। ওই চক্রের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট বার বার আবেদন করেও কোন প্রতিকার পাইনি। গত সোমবার (১৫ মে) ইউএনও সাহেবের সাথে দেখা করেছি। প্রতিবারের ন্যায় এবারো ফোনে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে ব্যবস্থা নিতে বলেন, ভূমি অফিসে আবেদন করতে বলেন। আমি বলেছি আপনি ব্যবস্থা নেন, তিনি আমাকে বলেন মামলা করতে। আমি গরিব মাানুষ ওদের সাথে মামলা করে জমি রক্ষা সম্ভব নয়।’
একই স্বরে কথা বললেন, ফতেহাবাদ ইউনিয়নের বিষ্ণপুর গ্রামের ভোক্তভূগী মৃত আদম আলীর পুত্র মাঈনুদ্দিন ও মইনুদ্দিন। তারা জানান, একই গ্রামের মাটি খেকু মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে প্রভাবশালী সামসুল হক এবং মামুন গোমতী নদীর ভেরী বাঁধের বাহিরের অংশে ভেকু দিয়ে অবৈধভাবে মাটি কাটার ফলে চলতি বর্ষায় গোমতী বাঁধ যেমন ঝুঁকিতে আমাদের বাড়িটিও ঝুকিতে, যে কোনমূহুর্তে ভূমি খেকুদের খননকৃত গর্তে বিলিন হতে পারে আমাদের থাকার সর্বশেষ ঠিকানাটি। আমরা গরীব মানুষ নিজেদের ভিটে মাটি রক্ষায় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করায় আমাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অমানবিকভাবে মারধর করেছে।’
গুনাইঘর উত্তর ইউপির ধলাহাস গ্রামের আবুল হাসেম জানান, ‘ওই গ্রামের প্রভাবশালী মাটি ব্যবসায়ী মৃত সাহেব আলী মেম্বারের পুত্র নজরুল ইসলাম সুদন অবৈধ ড্রেজারে মৎস খামারের নামে কৃষি জমি ধ্বংস করছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের পক্ষে প্রতিকারে ইউএনও, এসিল্যান্ড ও থানা পুলিশকে লিখিত অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার পাইনি। আমরা একদিকে প্রতিবাদ করে সন্ত্রাসীদের হুমকীর মূখে আছি, অপর দিকে আমাদের চোখের সামনে কৃষি জমিগুলো ড্রেজারের গর্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো একাধিক ভুক্তভোগী জানান, কুমিল্লা দেবীদ্বারে প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অবাদে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে কৃষি জমির মাটি লুটে নিচ্ছে ড্রেজার মালিক নজরুল মেম্বার ও তার সহযোগী মৎস খামারের মালিক ফরিদ মিয়া নামের এক ভূমিদস্যু। গত তিন বছর আগে উপজেলার এগারগ্রাম বাজারের দক্ষিন পার্শ্বে পশ্চিম পোমকাড়া গ্রামে প্রায় ৬০ শতাংশ (ভিপি তালিকা ভূক্ত) ফসলী জমি নিয়ে তাদের এই অবৈধ মাটি খনন ও বিক্রয় কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত তিন বছরে দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের পশ্চিম পোমকাড়া মৌজায় ১৭টি দাগে ২৪৭ শতাাংশ ফসলী জমির মালিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
তারা আরো বলেন, বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে তাদের ফসলি জমি। বিষয়টি মৌখিকভাবে ড্রেজার ব্যবসায়ীদের জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বরং এসব বিষয়ে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলে তাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে ড্রেজার ব্যবসায়ীর লোকজন। সব সময়ই ড্রেজার দেখাশোনার জন্য সাত-আটজন লোক ড্রেজারের আশপাশে থাকে বলে জানান কৃষকেরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড্রেজার ব্যবসায়ী ও ড্রেজার মালিক নজরুল মেম্বার বলেন, ‘আমি আর এ ব্যবসা করবনা, ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছি। মাটি উত্তোলনের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, আমার ড্রেজার মেসিন ভালো আছে কিনা তা পরীক্ষা করতেই মেশিন চালু করেছি।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা বলেন, ‘গোমতী নদীর চর থেকে এবং কৃষি জমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে মাটি কাটা ও ড্রেজার মেশিনের অত্যাচারে ভূক্তভোগীদের অনেক অভিযোগ পাচ্ছি। আমরা পর্যায় ক্রমে অভিযান চালিয়ে তা প্রতিরোধ করছি এবং অভিযান অব্যাহত আছে।’