Daily News BD Online

নওগাঁর শিশু আদালতে বৃক্ষরোপন ও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই পড়েও খালাস মিলছে শিশু অপরাধীদের

 


এ.বি.এম.হাবিব-

লঘু অপরাধে শাস্তি হিসেবে সাময়িক কারাদন্ড অথবা অর্থদন্ড। এ দুটি শব্দের সাথে কমবেশী আমরা সকলেই পরিচিত। তবে সেই দন্ডের বিপরীতে বই পড়া, বৃক্ষরোপন, অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ, মাদককে না বলা ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের  বিনিময়ে অভিযুক্তদের খালাস দেওয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।


বৃহস্পতিবার (০৯ নভেম্বর) দুপুর দেড়টার সময় নওগাঁর আদালত ভবনের চতুর্থ তলার শিশুবান্ধব আদালতে এমনই ব্যতিক্রমী চিত্রের দেখা মিলেছে।এই দিন নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ ও শিশু আদালত-২ এর বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মোঃ মেহেদী হাসান তালুকদার মাদক মামলায় অভিযুক্ত ৩ শিশুকে ভালো কাজের বিনিময়ে খালাস দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন। এর আগে ওই তিন শিশুকে বঙ্গবন্ধুর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" বই থেকে শিক্ষাগ্রহন ও ৫টি করে বৃক্ষরোপনের নির্দেশনা দেন বিচারক। রায়ের সময় ওই তিন শিশুকে বঙ্গবন্ধুর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" বই থেকে কিছু প্রশ্ন করেন। প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি বৃক্ষরোপনের প্রমাণস্বরূপ ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করলে আগামীতে অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ, মাদককে না বলা ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন অব্যাহত রাখার শর্তে ওই তিন শিশুকে খালাস দেওয়া হয়।


খালাস পেয়ে উচ্ছ্বসিত শিশুরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শিশু আদালতের এজলাসের বাইরে তাঁদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। খালাস পাওয়া শিশুরা বলেন, তিন বছর আগের মাদক মামলা নিয়ে সবসবই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হতো। ছাত্র জীবনের ভবিষ্যত নিয়েও আমরা শঙ্কিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" বই পড়া, ৫টি করে বৃক্ষরোপন এবং আগামীতে ভালো কাজ অব্যাহত রাখায় আমাদের খালাস দেওয়া হলো। বিচারক আমাদের ভালো হওয়ার যে সুযোগ দিয়েছেন, আমরা তাঁর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখবো।


শুধু ওই তিন শিশুই না। বিচারক মেহেদী হাসান তালুকদারের ভিন্নধর্মী আদালত পরিচালনা দেখে এদিন আদালত প্রাঙ্গনে আসা শিশু অপরাধে জড়িতদের অভিভাকরাও মুগ্ধ হয়েছেন। লালসালু ঘেরা প্রচলিত এজলাসে হয়নি বিচার কার্যক্রম। শিশু আইন অনুযায়ী শিশুদের জন্য আলাদা এজলাস তৈরি করা হয় আদালতে। সেখানে ছিল না আসামি ও সাক্ষীর কাঠগড়া। সরকারি কৌঁসুলি ও আইনজীবীদের কারও গায়ে ছিল না কোট, গাউন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পড়নেও ছিল না ইউনিফর্ম। অন্যদিন বিচারক এজলাসের নির্ধারিত চেয়ারে বসলেও এদিন আসন ছেড়ে নিচে নেমে আসেন। সাদামাটা পোশাকে চেয়ারে বসে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদেরও বসানো হয় বেঞ্চে। এজলাসের নিচে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে কথা বলেন শিশুদের সঙ্গে।


সংঘাতে জড়িত শিশুদের অভিভাবক বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, শেফালী সরেণ ও জেবুন্নেসা বলেন, এর আগে আমাদের সন্তানরা যখনই আদালতে  আসতো ভেতরের পরিবেশ দেখে এক প্রকার আতঙ্কের মধ্যেই থাকতো। তবে আজকের পরিবেশ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ছিলো। বিচারক কাছে ডেকে নিয়ে তাঁদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার পরামর্শ দিয়েছেন। এই প্রথম এজলাস থেকে বেরিয়ে সন্তানদের মুখে আমরা হাসি দেখেছি। এমন শিশুবান্ধব পরিবেশ পেয়ে বিচারকের কাছে নিজেদের সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমাদের সন্তানরা।


আদালত সূত্রে জানা যায়, আগে প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদের বিচার হতো। ২০২০ সালে আইন সংশোধন করে দেশের সবগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে শিশু আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শিশু আইনের শিশুদের জন্য আদালত কীভাবে গড়ে উঠবে তার বর্ণনাও দেওয়া হয়। কিন্তু এতদিন কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল এ নিয়ম। যথাযথভাবে বড়দের মতো শিশুদের বিচার হতো আদালতে। গত ২৬ অক্টোবর নওগাঁর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রথমবারের মতো এ আইনের নিয়ম মেনে শিশু আদালত বসানো হয়। প্রতি সপ্তাহে বৃস্পতিবার দিন শিশুবান্ধব পরিবেশে এই কার্যক্রম চালাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মেহেদী হাসান তালুকদার। এদিন সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয় বিচারকের এজলাস। যাতে লালসালু মোড়ানো এজলাস শিশুরা দেখতে না পায়। একইরকম পর্দা দিয়ে বেঞ্চ সহকারী, সাক্ষীদের দাঁড়ানোর মঞ্চ ও কাঠগড়া মোড়ানো হয়।


নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ ও শিশু আদালত-২ নওগাঁর বিশেষ কৌশলী মকবুল হোসেন বলেন, দেশ ও জাতি গঠনে আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যত। তাঁদের চিন্তা চেতনায় যাতে অপরাধের মানসিকতা প্রবেশ করতে না পারে সেজন্যই শিশুবান্ধব পরিবেশে আদালত পরিচালনার নিদের্শনা রয়েছে। সেই মোতাবেক গত ২৬ অক্টোবর থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার স্বাভাবিক ও সুন্দর পরিবেশে শিশুদের হাজির করে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, মামলার শুনানিকালে বিচারক মোঃ মেহেদী হাসান তালুকদার অভিযুক্ত প্রতিটি শিশু-কিশোরকে ভবিষ্যতে নতুন করে অপরাধে না জড়াতে এবং যার যার ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করছেন। ভালো হয়ে চলতে কার কী সমস্যা, তা জানার চেষ্টা করছেন। প্রয়োজনে শিশুদের অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। ভালো কাজের বিনিময়ে শিশুরা খালাস পাচ্ছে। এতে আগামীতে শিশুদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে।


নওগাঁ জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খোদাদাদ খাঁন পিটু বলেন, শিশু আইনে শুধুমাত্র সাজা নয়। সাজার বিপরীতে শিশুদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়াই এই আইনের মূল লক্ষ। সে লক্ষ পূরণ করতে গেলে অবশ্যই শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবে ভৌত অবকাঠামো না থাকায় নওগাঁয় সেটি সম্ভব হচ্ছিলো না। বর্তমান বিচারক সেই চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলা করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে শিশুবান্ধব পরিবেশে বিচারিক কার্যক্রম চালু করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এর ফলে শিশুমনে আদালত ও মামলা ভীতি সহজেই দূর হবে। সেই সাথে শিশুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও কমে আসবে। সারাদেশেই শিশু আদালতে এইভাবে কার্যক্রম পরিচালনা হওয়া উচিত।


নওগাঁ সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজেদুর রহমান বলেন, আইনের সাথে সংঘর্ষে ও সংস্পর্শে আসা শিশুদের অধিকার সম্পর্কে বর্তমান বিচারক যথেষ্ট সচেতন। শিশুবান্ধব পরিবেশে প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে শুনানি হচ্ছে।যাতে শিশুদের মনে নেতিবাচক কোন প্রভাব না পড়ে। এটি বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে একটি নতুন মাত্রা। সেই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকতে পেরে ভালো লাগছে।


উল্লেখ্য: ২০১৩ সালে বাংলাদেশে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৮ সালে আইনটির কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তাছাড়া যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের মতো কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।


একই আইনের ১৯(২) ধারায় বলা হয়েছে, শিশু আদালতের আসন বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন সব শিশু বিচার প্রক্রিয়ায় পিতা-মাতা বা তাঁদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ বা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর, যতদূর সম্ভব, সন্নিকটে বসতে পারে।


১৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত কক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে, বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করবে।


১৯(৪) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালতে বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাঁদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফর্ম পরিধান করতে পারবেন না।

এমন উদ্যোগে সচেতন মহল সহ সকলে প্রশংসা করছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন