আনোয়ার হোসেন রংপুর জেলা প্রতিনিধি
রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ ইট ভাটা বনাঞ্চল, লোকালয় ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। এসব ভাটায় আগুন জ্বলে, ইট পোড়ে। মাটি, খড়ি, ইট বোঝাই করে ট্রাকের পর ট্রাক আসে। ধুলো-ধোঁয়ার একাকার হয়ে থাকে চারপাশ। এর মধ্যই চলে শিক্ষার্থীসহ পথচারীদের আসা-যাওয়া, পড়াশোনা আর খেলাধুলা।
উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের পালগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শালটি শমস দিঘী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে মকবুল ইসলামের এমইউবি ভাটা, বড়দরগাহ্ ইউনিয়নের ডাসারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র ২’শ মিটার দুরে জোয়াদ মন্ডলের জেবিএফ ভাটা, কুমেদপুর ইউনিয়নের বাজে শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক সাজু মাস্টারের এবিএস নামে ২টি ভাটা, একই ইউনিয়নের কুমেদপুর চকপাড়া গ্রামে ফারুক মন্ডলের এফএমবি ভাটা, মদনখালী ইউনিয়নের কাদিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কাদিরাবাদ উচ্চবিদ্যালয় এবং লক্ষীপুর নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৫’শ মিটারের মধ্যে শহিদুল ইসলাম, মাজহারুল ইসলাম মাস্টার এবং মোস্তাফিজার রহমান মানিক মন্ডলের জিএনএম ভাটাসহ ৩টি ভাটা, টুকুরিয়া ইউনিয়নের মোনাইল দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাত্র ১’শ গজের মধ্যে ১ টি, ছাতুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাতুয়া দাখিল মাদ্রাসা ও ছাতুয়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র দেড়’শ গজের মধ্যে সবুজ মিয়ার এসআরএম, ভাটা, বড়আলমপুর ইউনিয়নের তাঁতারপুর গুচ্ছ গ্রাম সংলগ্ন আবুল কালামের পিকেবি ভাটা, পীরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মকিমপুর ২ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র ৩’শ গজ ১টি ইটভাটা এবং গঙ্গারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাত্র ১’শ মিটার দুরে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের ইটভাটা, শানেরহাট ইউনিয়নের ৩টি ইটভাটার ২টিই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন। এরমধ্যে ১টি হলো শানেরহাট পার্বতীপুর গ্রামে এইচএনআর ভাঁটা এবং পার্বতীপুর উচ্চবিদ্যালয় ও পার্বতীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১’শ মিটারের মধ্যে রায়তী সাদুল্যাপুর গ্রামে জোয়াদ মন্ডলের জেবিএফ ভাটা, মিঠিপুর ইউনিয়নের একবারপুর ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে সাদেকুল ইসলাম সাদার এমএস বিক্স, কাশিমপুর দারুল আমান দাখিল মাদ্রাসার মাত্র ৩০ মিটার দুরে আনিছার রহমানের পিবিএস নামের ১টিসহ ২টি অবৈধ ইটভাটা জ্বলছে দিবারাত্র। চতরা ইউনিয়নের চতরা উচ্চ বিদ্যালয়, চতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চতরা আলিম মাদ্রাসা, চতরা এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং, চতরা ২০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে মাত্র ২’শ গজ দুরে অনিক ব্রিক্স এর ইটভাটা রয়েছে।
আইন লঙ্ঘন করে পীরগঞ্জ উপজেলায় গড়ে উঠেছে ৫৫টি অবৈধ ইটভাটা। এরমধ্য ৪৪টি ভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে। সংখ্যার অর্ধেকের বেশি ৪টি ইউনিয়নে ২৯টি ভাটা রয়েছে। কুমেদপুর ইউনিয়নে ৭টি ভাটার মধ্য এক গ্রামের ২০০ গজের দুরত্বে রয়েছে ৫টি ভাটা। বন বীট এলাকা হিসেবে পরিচিত চৈত্রকোলে ৯টি, মদনখালিতে ৬টি ও টুকুরিয়ায় ৭টি ভাটা। এসব ভাটায় বনের কাঠ উজাড় করে প্রতিবছর ইট পোড়ানো হয়। ঝিকঝাক বা হাওয়া ভাটা ৩৯টি, এখনও উপজেলায় ১৬টি স্থায়ী চিমনী ভাটা রয়েছে। কয়েকজনের বিএসটিআই, শ্রম মন্ত্রণালয়ের কল-কারখানা, ভ্যাট, ট্যাক্স ও ফায়ার সার্ভিসের অনুমতিপত্র থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের লাইসেন্স নেই কারো।
২০১৮ সালে ৩২টি ভাটার ভিতরে এনামুল হক, রেজানুর শামীম ও আহসান হাবীবসহ ৩জনের পরিবেশের ছাড়পত্র মিলে। ২০১৯ সাল থেকে নতুন করে গড়ে উঠাসহ ৫৫ ভাটার কাউকে পরবর্তি বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দেয়নি। তবে ভাটা মালিকরা প্রতিবছর পরিবেশ অধিদপ্তরে নিদ্ধার্রিত নবায়ন ফি জমা দিয়ে অনুমতির চিঠি ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। কেউ কেউ হাইকোর্টে রীট আবেদন করে ভাটা চালাচ্ছেন। এ বছরও ২২টি ভাটা হাইকোর্টে রীট মুলে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ২০১৩ সালে উচ্চ আদালত স্থায়ী চিমনী ভাটা বন্ধ করে দিলেও আদালতের রায় উপেক্ষা করে স্থায়ী চিমনীতে ১৬টি ভাটা চলছে এ উপজেলায়। খোদ উপজেলা সদরের এক কিলোমিটার দুরত্বে মহাসড়কের পাশ্বে মকিমপুরে স্থায়ী চিমনীতে আগুন জ্বলে বছরের পর বছর।
কাদিরাবাদ এলাকার উচ্চ মাধ্যমিক পড়–য়া শিক্ষার্থী সুচি, দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সৌমিকসহ স্কুল-কলেজগামী অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী জানান, ভাটার ঘোঁয়ায় একাকার হয়ে থাকে চারপাশ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখ মেলতে কষ্ট হয়। মুখে ওড়না পেঁচিয়ে চলাচল করতে হয়। অনেক সময় উড়ে আসা ছাই চোখেমুখে লাগে।
অধিকাংশ ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। ভাটায় কিছু কয়লা রেখে জ্বালানি কাজে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে বনের কাঠ। জ্বালানি কাজে কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা তোয়াক্কা করছে না ইটভাটার মালিকেরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়েই অবাধে পোড়ানো হচ্ছে ইট। ভাটার ধোঁয়া পরিবেশ নষ্ট করছে এবং ভাটার কাজে নিয়োজিত গাড়ি চলাচলে ধুলাবালির কারনে এলাকার কোমলমতি স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েসহ পথচারীদের শ্বাসকষ্ট জর্নিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। সরকারি বিধি লংঘন করে বন এলাকায় এবং স্কুল কলেজসহ বসতবাড়ির পাশেই গড়ে তুলেছে ইটভাটা।
এছাড়াও প্রতিদিন হাজারো মহেন্দ্র দিয়ে কৃষি জমির মাটি ভাটায় বহন করা হচ্ছে, ইটভাটাগুলো নির্বিচারে মাটি গিলে, পোড়া ইট বের করছে। ইটভাটার গাড়ি স্কুল কলেজ, হাটবাজারের পরিবেশ নষ্ট করছে এবং রাস্তাঘাটের বাকল বা ছাল তুলছে। এদের কারনে এলাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত কয়েক বছরে কিছু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অবৈধ ভাটার গাড়ি। অদক্ষ ছোট ছোট ছেলে ড্রাইভার দিয়ে গোটা উপজেলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ মহেন্দ্র্র গাড়ি। এদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই কোনো কাগজপত্র।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চৈত্রকোল ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে ইএসবি আতাউর রহমান আতা, পত্নীচড়ায় আরএইসআর রাঙা মন্ডল, এনবিকে রেশমি বেগম, এমপিটি কালাম মিয়া, খালাশপীর এএইসবি আজির হাজী, এআরবি রাসেল মিয়া, কাদিরাবাদ এএসবি শহিদুল ইসলাম, এমডিবি মাজহারুল ইসলাম, এনআরটি মানিক মন্ডল, টুকুরিয়া এসআরবি, শাল্টিতে এইসইবি মিজানুর রহমান, কুমেদপুর কাঞ্চগাড়ি ও চাক পাড়ায় এফএফএম ফারুক মিয়া, কানঞ্চগাড়ি এমইউএম মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অধিকাংশ ভাটায় কয়লার পরিবর্তে বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে।
ভাটা মালিক ফারুক মন্ডল (এমএসবি), আফতাবুজ্জামান আতা (ইএসবি) ও মিজানুর রহমান (এমএইচবি) জানান, ভাটা আগুন ধরে রাখতে কয়লার পাশাপাশি খড়ির ব্যবহার করতে হয়। ভাটা ব্যবসায়ি রেজানুর রহমান শামীম (এইচএনআর) জানান, ইট পোড়ানোর কাজে কয়লার পরিবর্তে অনেকে কাঠ ব্যবহার করছে, ইট উৎপাদনে কাঠ ব্যবহারকারীদের উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কয়লা চালিত হাওয়া ভাটা।
ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এনামুল হক জানান, ২০১৯ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী দুরত্বের কারনে পরিবেশ অধিদপ্তর কাউকে অনুমতি পত্র দিচ্ছে না। ২০২৪ সালে বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশে উপজেলা নিবার্হী কর্মকতার্ ২৮টি ভাটা বন্ধে নোটিশ জারি করে। এছাড়াও পরিবেশ ও বিএসটিআই ১৪/১৫টি ভাটায় নিয়মিত মামলা রুজু করেছেন। সমিতি’র তরফ থেকে সরকারের কাছে দুরত্বের বিষয়টি ১০০০ মিটারের স্থলে ৫০০ মিটার করতে দাবি জানানো হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকতার্ সাদেকুজ্জামান জানান, ইট ভাটায় কৃষি জমির ’টপ সয়েল’ ব্যবহৃত হয়। এতে ২/৩ বছর কৃষি জমির উৎপাদন ব্যহত হয়। মাটি কাটা জমি গুলোতে অতিরিক্ত খরচ করে চাষাবাদ হলেও কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না।
উপজেলা বন অফিসার মিঠু তালুকদার জানান, ইটভাটায় জ্বালানি কাজে কাঠ পোড়া সম্পুর্ণরুপে নিষেধ। কোন ভাটা মালিক পোড়াই কাজে কাঠ পোড়াতে পারবে না। অধিকাংশ ভাটায় দেখা যায় কয়লা লোক দেখানোর জন্য ভাটার সামনে রেখেছে অথচ জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে উপজেলা মহোদয়কে অবগত করেছি এবং তিনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুরের সহকারি পরিচালক কমল কুমার বর্মন জানান, ২০২২ সালের উচ্চ আদালতের নির্দেশনামতে ভাটা বন্ধে নোটিশ জারিসহ ভ্রাম্যমান আদালত অব্যাহত রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাদিজা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ইতিপূর্বে কিছু ভাটায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে আর মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রয়েছে।