Daily News BD Online

টমেটোর বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি

 


কৃষি নির্ভর গ্রামবাংলা আজ বদলে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সংস্পর্শে। বর্তমানে কৃষক বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদ পদ্ধতি ও ডিজিটাল সুবিধায় কৃষিকাজ করছে। 


ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের হলিধানী গ্রামের মোহাম্মদ হুজুর আলী পেশায় একজন আলমসাধু চালক। গাড়ি চালিয়ে সংসার চলে তার। সামান্য কিছু জমানো টাকা দিয়ে ৩০ শতক জমি বন্ধক নিয়ে চাষ করতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন। কখনো সেচের অভাব, কখনো পোকামাকড়ের আক্রমণ, আবার কখনো ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তার আয় ছিল অপ্রতুল। কিন্তু তিনি এবছর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেন। কৃষি অফিসের প্রণোদনা ও সহযোগিতায় টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করেছেন। যেখানে মাটির আর্দ্রতা ঠিক রাখতে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করা হয়েছে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ। যার ফলে সুতা ও বাঁশের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলে আছে (স্মার্ট ২২১৭ এবং বাহুবলি) জাতের টমেটো। এভাবে টমেটো চাষে হুজুর আলীর শুধু খরচই কমেনি, ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে কয়েকগুণ।


সরেজমিনে দেখা যায়, টমেটো চারারোপণের আগে, দুটি জমিতে পৃথক প্রযুক্তি ব্যবহার করে টমেটো চাষ করা হয়েছে। একদিকে শুধু সুতা আর বাঁশের চটা দিয়ে মাচা করে টমেটো চাষ করা হয়েছে। অন্যদিকে জৈবসার দিয়ে জমিটা ভালোভাবে প্রস্তুত করে আলাদা আলাদা বেড করে মালচিং পেপার দিয়ে বেডটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। দুই ফুট দূরুত্বে টমেটো গাছ লাগানো হয়েছে। সুতা ও বাঁশের চটার মাচায় গাছগুলো বেড়ে উঠেছে। গাছের নিচ থেকে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে টমেটো। দুটি জমিতে আলাদা আলাদা প্রযুক্তি ব্যবহার করায় ফলনও পেয়েছেন ভিন্ন। হুজুর আলী ও তার দুই ছেলে মিলে টমেটো ক্ষেত পরিচর্যা করেন। আর কিছুদিন পরেই এই টমেটোগুলো বাজারে ভালো দামে বিক্রয় করবেন এমনি প্রত্যশা তাদের।


উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলাতে ২ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হচ্ছে। তার মধ্যে ১৮০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের টমেটো চাষ করা হয়েছে। ৫ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করা হয়েছে যার মেধ্য ১০ জন কৃষককে স্মার্ট ২২১৭ এবং বাহুবলি জাতের টমেটোর প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। এই প্রদর্শনীর আওতায় হুজুর আলীকেও টমেটোর প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে।


কৃষক হুজুর আলীর ছেলে সুমান বলেন, আমার বাবা একজন আলমসাদু গাড়ি চালক। গাড়ি চালানোর পাশাপাশি প্রথমবার টমেটো চাষ করেছে। আমরা দুই ভাই লেখাপড়া করি। লেখাপড়ার পাশাপাশি টমেটো বাগানে বাবার কাজে সহযোগিতা করি। আমাদের জমিতে যে টমেটো চাষ করা হয়েছে তার ফলন খুব ভালো হয়েছে। প্রতিবেশী কৃষক শিটন বলেন, গত বছর কৃষি অফিস থেকে একই মাঠে একটা গ্রীষ্মকালীন টমেটো প্রদর্শনী দিয়েছিল। সেই প্রদর্শনী দেখে অনেকেই এখন টমেটো চাষ করেছে। এবছরও হুজুর আলীকে টমেটো প্রদর্শনী দিয়েছে কৃষি অফিস। তবে এই প্রদর্শনীতে গত বছরের তুলনায় অনেক ভালো ফলন হয়েছে। এমন উচ্চ ফলনশীল টমেটো আগে কখনো দেখা যায়নি। হুজরি আলী নতুন চাষি হলেও এই চাষে অনেক লাভবান হবে বলে আশা রাখি।


কৃষক হুজুর আলী  বলেন, পাশাপশি দুই জমিতে এবারই প্রথম টমেটো চাষ করেছি। একটা জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা হয়েছে, অন্য জমিতে সাধারণভাবে চাষ করা হয়েছে। সাধারণ জমিতে একটা গাছ থেকে ২ থেকে আড়াই কেজি টমেটো পাওয়া যাবে। আর যে জমিতে কৃষি অফিসের প্রদর্শনী এবং সহযোগিতার মাধ্যমে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই জমিতে একটা গাছ থেকে ৪ থেকে ৫ কেজি টমেটো ফলন পাব। আমার এই চাষ অনেক ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করেছিলাম বাজারে টমেটোর দাম ভালো পাব। ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করতে পারব। কিন্তু বর্তমান যে বাজার সেখানে ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রয় হচ্ছে। আমার যে টমেটো বর্তমান দামে বিক্রয় করা হলেও লাভ হবে। তবে বাজার যদি একটু ভালো হয় তাহলে অনেক লাভবান হব।


হলিধানী ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. মোফিজ উদ্দীন বলেন, গত বছর একই মাঠে কৃষি অফিস থেকে দুইটা প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রদর্শনী দেখে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ শুরু করে। হুজুর আলী নতুন চাষি হওয়ায় প্রথমে যে জমিতে টমেটো চাষ শুরু করে সেই জমির টমেটোর ফলন ভালো হয়নি। পরে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন টমেটো প্রদর্শনী দেওয়া হয় এবং সব ধরনের কারিগরী সহযোগিতা করা হয়। বর্তমানে তার প্রদর্শনী জমিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় দ্বিগুণ ফলন পাবে বলে আশা করি। এখানে যে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে সেটা মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করবে। আবার পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি অন্য জমির তুলনায় এই জমিতে শ্রমিক, সেচ, সার খরচও অনেক কম এবং আগাছা নিড়ানোর ঝামেলাও নেই। যার ফলে এই পদ্ধতিতে চাষ করে কৃষক অনেক লাভবান হবে।


ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি অফিসার নূর-এ-নবী বলেন, এ বছর রবি মৌসুমে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ করা হয়েছে। এর ভেতরে ফুলকপি, শিম, টমেটো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে এ বছর টমেটো আবাদে নতুন প্রযুক্তি লক্ষ্য করছি। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় নতুন প্রযুক্তিও কৃষকের কাছে দিয়েছি। তার মাধ্যমে টমেটোর ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই টমেটো যারা আগাম শীতকালীন হিসেবে আবাদ করেছিল, তারা শীতের শুরুতেই বাজারে বিক্রয় করতে পরেছে এবং ভালো দাম পেয়েছে। আমরা দেখছি এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যদি মালচিং ব্যবহার করা হয় এবং টমেটো গাছ যেহেতু অনেক বড় হয়ে লতানো টাইপের হয়। সেইক্ষেত্রে এটাকে যদি সঠিক ভাবে খুটি দিয়ে একটু উপরে তুলে দেওয়া যায়, এর আগা যদি ঝুলে থাকে তাহলে টমেটোর ফলন বেশি হয়। আমাদের কৃষককে সেভাবে পরামর্শ দিয়েছি। বেশ কয়েক জায়গাই দেখতে পাচ্ছি, সেই ভাবে টমেটো আবাদ করা হয়েছে এবং তাদের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। আমাদের কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্ত প্রতিনিয়তো কৃষকের পাশে থেকে সকল সবজি চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। বিভিন্ন রোগ বালাই দমনে তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং মাঝে মাঝে সহযোগিতাও করা হচ্ছে। যদিও বর্তমান সবজির বাজার একটু কম, এই বাজার আগামীতে বাড়বে এবং কৃষকরা লাভবান হবে। তবে হুজুর আলীর এই সাফল্য স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে উদ্ভাবনী চাষাবাদ পদ্ধতি গ্রহণে আগ্রহী করে তুলবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন