বরই চাষে বছরে আয় ৩০ লাখ টাকা



 আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গম, ধান ও সরিষা অর্থাৎ দানা জাতীয় ফসলের চাষ বেশি হয়। এবার বরই চাষে সাফল্য পেয়েছেন গোমস্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা সামিউল হক ও নেফাউল রহমান। ইউটিউবে ভিডিও দেখে ব্যাণিজিকভাবে বরই চাষে উদ্বুদ্ধ হন তারা। তাদের ২৫ বিঘা বরই বাগান থেকে এ মৌসুমে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকার বরই বিক্রির আশা করছেন। আর সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের লাভ থাকবে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের ডাংইপাড়া এলাকায় জমি লিজ নিয়ে এই বরই বাগান গড়ে তুলেছেন সামিউল ও নেফাউল। তারা সম্পর্কে আত্মীয়।


সরজমিনে বরই বাগানে গিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ আট বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরেন সামিউল হক। এরপর তিনি বেকার সময় কাটাতে শুরু করেন। হঠাৎ ইউটিউবে বরই চাষের ভিডিও দেখে ব্যাণিজ্যিকভাবে বরই বাগান করার চিন্তা মাথায় আসে তার। পরে তার এক নিকট আত্মীয় নেফাউল রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। নেফাউল রহমান আগে থেকেই কৃষিকাজ করতেন এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঁচামাল কিনে হাটে গিয়ে বিক্রি করতেন। তারা দুইজনে পরামর্শ করে প্রথমে ১৬ বিঘার মতো জমি লিজ নেন। প্রথমদিকে বরই চাষ করে তেমন সফলতার মুখ না দেখলেও এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তাদের বাগানে ভালো ফলন এসেছে।


এ ছাড়া এই বরই বাগানে বল সুন্দরী, কাশ্মীরি, ভারত সুন্দরী, বেবি কুল, আগাম গুটি কুল, নারিকেল ও বাউ কুল জাতের বরই চাষ হচ্ছ। বাগানে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক বাগান পরিচর্যাকারী হিসেবে কাজ করেন এবং তারা দৈনিক ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা বেতন পান। গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এই জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায় আম চাষের পাশাপাশি মাল্টা, বরই, কমলাসহ অন্যান্য ফসলও চাষ হয়ে থাকে। গত অর্থবছরে গোমস্তাপুর উপজেলায় বরই চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬০ হেক্টর জমিতে। যা এই অর্থবছরে ৫ হেক্টর বেড়ে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ হেক্টর জমিতে।


বরই বাগানের পরিচর্যা কর্মী রহমত আলী বলেন, আমি এই বাগানে বরই ভাংগি ও ক্যারেট করি। এ ছাড়া গাছে পানি ও সার দেওয়ার কাজও করি। আমরা এই বাগানে দুই বছর যাবত কাজ করছি। এখানে দিনে ৪০০ টাকা বেতন পাই। যা দিয়ে আমাদের পরিবার চলে এবং আমাদের অনেক সুবিধা হয়। আমরা এখানে সকাল ৮টার দিকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কাজ করি। পরে খাবার বিরতি শেষে আবার দুপুর ১ থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করি।


জাহিদ নামে বাগানের আরেক পরিচর্যা কর্মী বলেন, আমরা আগে বেকার ছিলাম। এখানে বরই চাষ করা দেখে আমরা কাজে এসেছি। প্রতিদিন সাড়ে ৪০০ টাকা করে বেতন পেয়ে আমরা অনেক খুশি। এতে ফ্যামিলি চালাতে অনেক সুবিধা হয়। আশা করি ব্যবসাটা অনেক এগিয়ে যাক এবং কাজ করে যেন আমরা সুবিধা পাই। এখানে আমরা মূলত বরই ভাঙ্গি, ক্যারেট করি এবং আবার সেই ক্যারেট দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর কাজ করি।


বরই চাষি নেফাউল রহমান বলেন, রহনপুরে আমাদের বাগান করার প্রায় পাঁচ বছর হলো। এর আগে আমরা ব্যাবসা করতাম, তবে এইভাবে ব্যাণিজ্যিকভাবে করিনি। ব্যাণিজ্যিকভাবে প্রায় পাঁচ বছর থেকে বাগান করছি। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর বাজারজাত ভালো হওয়ার কারণে সবকিছু বাদ দিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো আয় হবে। আমাদের এখানের বাগানের বরইগুলো অনেক সুস্বাদু। তাই চিটাগাং, ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গাতে যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এসে এখান থেকে বরই কিনে নিয়ে যান।


বরই চাষি সামিউল হক বলেন, আমি দীর্ঘ আট বছর প্রবাসে থাকি এবং ২০১৯ সালে প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসি। দেশে আসার পর বেকার ছিলাম। হঠাৎ ইউটিউবে দেখতে পাই কুল (বরই) চাষ। তাই কুল চাষে আমার আগ্রহ হয় এবং আমি এক (নেফাউর রহমান) আত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করি। পরে তাকে সঙ্গে নিয়েই প্রথমে ১৬ বিঘা জমি লিজ নিই। আর এখন ৪০ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করছি। এ ছাড়া আমার বাগানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জনের মতো কাজ করেন। তাদের কর্মসংস্থান করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এই বছর প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছি। আরও ৪০ লাখ টাকা পাবো বলে আশা করছি। আর সবকিছু বাদ দিয়ে ৩০ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছি।


তিনি আরও বলেন, গত বছর আমাদের আয় কম হয়েছিল। সব মিলিয়ে ১৫ লাখ টাকার মতো টিকেছিল। এই বছর ৩০ লাখ টাকার মতো আয় হবে বলে আশা করছি। প্রায় চার বছর হয়েছে বাগান করছি। বিগত তিন বছর আমি কৃষি অফিস থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। এখানে কৃষি অফিসার তানভীর স্যার আসার পর তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি আমাকে উৎসাহ দেন। তার পরামর্শেই আমি অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছি। কৃষি অফিস থেকে কিছু সার আর মেশিন সহযোগিতা পেয়েছি এবং আরও কিছু দেবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া এই বাগানে বরইয়ের সঙ্গে মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, পেয়ারা, মাল্টা ও কাটিমন আমও চাষাবাদ করছি।


গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি অফিসার তানভীর আহমেদ সরকার বলেন, আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায় শুধু আম চাষই হয় না, এই উপজেলায় আম চাষের পাশাপাশি মাল্টা, কমলা, বরইসহ অনান্য ফলেরও চাষ হয়ে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় গোমস্তাপুর উপজেলা ফুল, ফল ও ফসলে একটি বৈচিত্র্যময় উপজেলা। গোমস্তাপুর উপজেলায় এইবছর ১৬৫ হেক্টর জমিতে বরই চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬০ হেক্টর জমিতে। আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় কৃষকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে বরই চাষ যে একটি লাভজনক চাষ সেটি কৃষকে বুঝিয়ে এবং অনুপ্রাণিত করে বরই চাষ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি।


তিনি আরও বলেন, গোমস্তাপুর উপজেলায় প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে সামিউল হক নামে একজন উদ্যোক্তা বরই চাষ করছেন এবং সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা সামিউল হকের বাগান পরিদর্শন করেছি। তাকে বিভিন্নভাবে কৃষিবিষয়ক পরামর্শ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ে যতটুকু সহযোগিতা আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রয়োজন ততটুকুই সহযোগিতা আমরা করেছি। তিনি বরই চাষের পাশাপাশি আম ও পেয়ারাও চাষ করে থাকেন। তাকে কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়েও সহযোগিতা করেছি। যাতে তিনি আবাদটা সুন্দরভাবে করতে পারেন এবং সার্বক্ষণিক আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যাতে কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমরা সহজে তাকে কৃষিবিষয়ক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি এবং তার লাভজনক কৃষির ধারাটা যেন বজায় রাখতে পারে ও ব্যাণিজ্যিকভাবে যেন কৃষিটাকে এগিয়ে নিতে পারেন সেই প্রচেষ্টা আমরা চালাচ্ছি। এ ছাড়া পার্টনার প্রোগামের আওতায় তাকে ক্যাপের ট্রেনিং দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি এবং তার বরই বাগানটিকে ক্যাপের আওতায় নেওয়া যায় কি না সেই চিন্তাভাবনা থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অতিশিগগিরই হয়তো এই বাগান থেকে বরই বিদেশেও রপ্তানি করা হবে সেই পরিকল্পনাও আমরা গ্রহণ করেছি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন