বেয়াইকে নিয়ে আ.লীগ নেতার বালু বাণিজ্য, ঝুঁকিতে স্লুইসগেট



 বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ কার্যক্রমে পরিচালিত লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় রহমতখালী চ্যানেলে স্লুইসগেটটি (রেগুলেটর) ঝুঁকিতে রয়েছে। স্লুইসগেটের গাইড ওয়ালের সঙ্গেই বাল্কহেড ও ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে বালু ব্যবসা এ ঝুঁকির প্রধান কারণ। আইন অনুযায়ী, ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো নৌযান রাখা যাবে না। কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে প্রায় ১৫ মিটারের মধ্যেই বাল্কহেড ও ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে বালুর ব্যবসা করে আসছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল মেম্বার ও তার বেয়াই বাদশা মোল্লা।  

এদিকে ৫ আগস্ট সরকার পতন হলেও এখনো পুরোদমে তাদের গায়ের জোরে চলছে সেই বালু ব্যবসা। তাদের ব্যবসার কারণে বসানো ড্রেজিং ও বাল্কহেড খুব কাছাকাছি হওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে স্লুইসগেটটি। একই সঙ্গে বাল্কহেডের নিচে পানির তলদেশে বালু জমে গেট এলাকায় নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় আড়াই মাস আগে সদর উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল গিয়ে স্লুইসগেট এলাকা থেকে ড্রেজিং মেশিন ও বাল্কহেড সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দিলেও তা মানেনি বালু ব্যবসায়ীরা।

রেগুলেটর এলাকার ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে বালুর বাল্কহেড ও নৌযান রাখার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ একটি লিখিত নোটিশ দেন। নোটিশটি বাপাউবো পূর্বাঞ্চল কুমিল্লার প্রধান প্রকৌশলী, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ ১২টি দপ্তরে দেওয়া হয়। 


অভিযুক্তরা হলেন- বাবুল সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তিনি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য, জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি ও চররমনী মোহন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন মেম্বারের ভাতিজা। অন্যদিকে আইন জেনেও তা অমান্য করার ঘটনা স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসায়িক অংশীদার ও বেয়াই বাদশা মোল্লা। প্রায় আড়াই মাস আগে প্রশাসন থেকে নির্দেশনা দিলেও তারা ড্রেজিং মেশিন ও বাল্কহেড বসিয়ে ব্যবসা পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে নিয়েছেন তারা। এজন্য কেউই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।


সম্প্রতি মজুচৌধুরীরহাট পুরাতন স্লুইসগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গেইট থেকে প্রায় ১৫ মিটারের মধ্যেই একটি ড্রেজিং মেশিনের মাধ্যমে দুটি বাল্কহেড থেকে বালু অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। এর বিপরীত পাশেই ৫টি বালুবাহী বাল্কহেড নোঙর করা ছিল। ফেরি ঘাট থেকে রেগুলেটরের দিকে তাকালে সেখানে প্রশস্ত জলরাশিকে চিকন নালার মতো দেখায়। দু’পাশের বাল্কহেডের কারণেই এমন দৃশ্য দেখা যায়।


স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর মেম্বার মজুচৌধুরীরহাট এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। তার ভাতিজা বাবুল মেম্বার বেয়াই বাদশাকে নিয়ে বালুর ব্যবসা শুরু করেন। মেঘনা নদী হয়ে রহমতখালী খালের এ চ্যানেলে দুটি স্লুইসগেট রয়েছে। এ ব্যবসার জন্য তারা পুরাতন স্লুইসগেট এলাকা বেছে নেয়। গেটের খুব কাছেই গাইডওয়াল ঘেঁষে তারা ড্রেজিং-মেশিন ও বাল্কহেড বসিয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে যেকোনো সময় রেগুলেটরের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। একইসঙ্গে জোয়ারের পানির সঙ্গে আসা বালু ড্রেজিং মেশিন ও বাল্কহেডের তলদেশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে জমাট বেঁধে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। ওই পানি সদর উপজেলার ২১টি ইউনিয়নসহ নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখন গেট খুলে দিলেও নাব্যতা সংকটের কারণে জোয়ারের পানি খালে পর্যাপ্ত পরিমাণে যাচ্ছে না। এতে চাষাবাদের জন্য সেচের পানি পাচ্ছে না কৃষক।


এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বাবুল মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার ব্যবসায়ীক অংশীদার বেয়াই বাদশা মোল্লা বলেন, ১৩ বছর ধরে স্লুইস গেট এলাকায় বাল্কহেড এনে ড্রেজিং মেশিনের মাধ্যমে বালু ব্যবসা করে আসছেন। মাসে প্রায় ৪ লাখ ঘনফুট বালু এখান থেকেই স্থানান্তর করা হয়। গেটের ১০০ মিটারের মধ্যে বাল্কহেড ও ড্রেজিং মেশিন বসানো যাবে না আইন তারা জানে। এরপরও তারা এটি করে আসছে। তাদের দাবি এতে গেইটের কোনো ক্ষতি কিংবা নাব্যতা সংকটও হচ্ছে না। প্রায় আড়াই মাস আগে প্রশাসনের লোকজন ড্রেজিং মেশিন ও বাল্কহেড সরিয়ে নিতে বলেছেন। এরপর আর কেউ এটি নিয়ে কথা বলেনি। এজন্য সরানোও হয়নি।


লক্ষ্মীপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ-জামান খাঁন বলেন, বর্ষা মৌসুমে নদীতে জোয়ার আসলে বন্যা রোধে স্লুইসগেটগুলো বন্ধ রাখা হয়। শুস্ক মৌসুমে চাষাবাদে পানি সেচের জন্য জোয়ারের সময় গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়। এখন কৃষি জমিতে পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন। কিন্তু গেট এলাকায় বালুবাহী বাল্কহেডগুলোর কারণে নাব্যতা সংকট দেখা দিচ্ছে। এতে জোয়ারের সময় গেট খুললে পর্যাপ্ত পানি যাচ্ছে না খালে। আইন অমান্য করে স্লুইস গেটের কাছে বাল্কহেড ও ড্রেজিং বসানোই হচ্ছে এর প্রধান কারণ। এ নিয়ে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত প্রতিবেদন দেব।


লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জামশেদ আলম রানা বলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অমিত সাহা ঘটনাস্থল গিয়ে সংশ্লিষ্টদের স্লুইসগেট এলাকা থেকে নিয়ম অনুযায়ী ড্রেজিং মেশিন ও বাল্কহেড সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপরও কেন সরাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এনিয়ে বাল্কহেড মালিক-সমিতির সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন