‘নদীত পানি নাই, চাইরো পাকে শুকি গেইছে। যখন পানি নাগে তখন তো ভারত পানি দেয় না। পানির অভাবোক ঠিক মতন হামার আবাদ হয় না বাহে। আগের মতো এ্যলা আবাদ না হওয়াতে বছরে বছরে খালি লোকসান বাড়ে। যখন যে সরকার গোদিত বসছে হামাক খালি তিস্তা নিয়্যা স্বপ্ন দ্যাকাইচে। কায়ো তো কামের কাম কিছুই করে নাই।’
প্রতিবছর সময়-অসময়ের বন্যায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে তিস্তা নদীর। উজানের পলিতে ভরাট হয়েছে নদীর বুক। ফলে বর্ষায় ভারতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিতে তিস্তায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পারাপার হন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রতিবছর দুই কোটি টনের বেশি পলি আনছে তিস্তা। শুষ্ক মৌসুমে যেখানে তিস্তার পানির প্রবাহ ৫ হাজার কিউসেক থাকার কথা, সেখানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪০০ কিউসেকে। ফলে পানির অভাবে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
তিস্তা অববাহিকায় শুধু কৃষিই নয়, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিলীন হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম, বন্ধ হয়ে গেছে নদী-নির্ভর যোগাযোগব্যবস্থা। এতে জেলে, মাঝিসহ লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা এখন চরম সংকটে পড়েছে। বর্ষাকালে পানির স্রোত থামানো যায় না যে তিস্তায় সেটাতে শুষ্ক মৌসুমে বালু ছাড়া কিছুই থাকে না। এখন পানি না থাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, তিস্তা নদীর অববাহিকায় বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রতিবছর ভুট্টা, মরিচ, কুমড়া, বাদাম, গম, তিসি, সূর্যমুখী ও পাট চাষ হয়। কিন্তু এসব ফসল ফলাতে কৃষকদের কষ্টের যেন শেষ নেই। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকা, আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকদের।
গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র নাথ বলেন, আগোত নদী ম্যালা গভীর ছিল। বড় বড় নৌকা যাতায়াত করছিল। এ্যালা তো তেমন গভীরতা নাই। শুকানের দিনোত মানুষ হাঁটি নদী পার হয়। নদী পার হয়া ঘোড়া গাড়িত করি হামরা ফসল নিয়া যাই।
স্থানীয় জেলে রবিউল ইসলাম বলেন, নদীত পানি না থাকলে মাছ পাওয়া যায় না। ভারত তো হামাক চাইরো পাক দিয়্যা মারছে বাহে। পানির অভাবে চাষাবাদ করিয়্যাও শান্তি নাই। আগোত আবাদ সুবাদ করছি, মাছও ধরছি। এ্যালা কোনোটায় ঠিক মতো করা হয় না।
ছালাপাক গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, শুকনো মৌসুমে আমাদের এলাকায় পানির খুবই সংকট থাকে। এ সময় সেচ দিতে অনেক খরচ হয়। বিভিন্ন রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। আবার যখন বর্ষা হয় তখন ভারত পানি ছাড়ে। এতে আমাদের এলাকা প্লাবিত হয়। বর্তমান ইউনূস সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া ভারত থেকে যেন পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে।
চর ইছলিতে কথা হয় কৃষক মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হামরা নদীপাড়ের মানুষ। সুখ-দুক্কের হিসাব করার সময় নাই। খরা, বান-সাঁতাওয়ের সাতে হামার বসবাস। বছরে বছরে ভারতে থাকি আইস্যা বালু পড়ি পড়ি নদীর তলপেট ভরাট হইছে। সরকার তো নদী বান্দি দেবার কতা কয়া ভোট নিয়্যা পালে গেল। হামার তিস্তা মহাপরিকল্পনার কোনো কাম করিল না বাহে।
নদীর ভাটিতে যখন পানির অভাবে ভয়াবহ মরুকরণের মুখে তিস্তা অববাহিকা, তখন উজানে চলছে বিপরীত চিত্র। আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে তিস্তার উজানে ভারত একাধিক বাঁধ, খাল, জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ফলে তারা ইচ্ছামতো তিস্তার পানি ব্যবহার করছে, আর বাংলাদেশকে রেখেছে পানির সংকটে। এছাড়া এই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতিও এখন ধ্বংসের সম্মুখীন।
৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এ দেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে, বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তরের পাঁচ জেলার দুই কোটি মানুষের জীবনমান রক্ষায় একমাত্র সমাধান হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। নদীকেন্দ্রিক কৃষিজমি রক্ষা, ভাঙন রোধসহ চরগুলো রক্ষায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো উজানের পলিতে নদীর বুক ভরাট হলে স্বল্প পানিতে প্রতিবছর অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। তারা মনে করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি তিস্তা নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।
আইনজীবী ও সংগঠক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রংপুরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সরকারের বিশেষ গুরুত্বের অংশ হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক। তিস্তা ব্যারাজ তৈরি করে উত্তরাঞ্চলে খরার সময় মঙ্গা দূর করা হয়েছে, তেমনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রাণ-প্রকৃতিকে ঠিক রেখে বাস্তবায়ন করা হলে এখানকার জনগোষ্ঠী আত্মনির্ভরশীল হবে এবং দেশের উন্নয়নকে চলমান রাখা সম্ভব হবে।
নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তাকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদী। এটি নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর উজানের ঘোলা পানির সঙ্গে আসা পলি, পাথরসহ ময়লা-আবর্জনায় তিস্তার বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তাপাড়ে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা। নদীভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার। অথচ তিস্তাকে ঘিরে এ অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা চলে। তিস্তা যদি আরও মরে যায় তাহলে কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তিস্তায় সারাবছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, ভাঙন, বন্যা, খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকসহ অসহায় মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি।
এদিকে তিস্তাকে সুরক্ষা করা না গেলে শুধু জীবন জীবিকাই নয় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে নদী বিস্তৃত ২ হাজার বর্গকিলোমিটার জনপদের মানুষ। এ কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি পালন করছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন। রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে তিস্তা বিস্তৃত ১১টি পয়েন্টে গতকাল সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) শুরু হওয়া এ কর্মসূচি শেষ হবে আজ।
গতকাল কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিগত ১৫ বছরে ভারতের কাছে বাংলাদেশ থেকে অনেক কিছু বেচে দিয়েছে কিন্তু তিস্তার একফোঁটা পানি আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শুধু তিস্তা নয়, ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। বাঁধ দিয়ে তারা পানি তুলে নিয়ে যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর আমাদের দেশের মানুষ এখানে ফসল ফলাতে পারে না। জীবন-জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়। জেলেরা মাছ ধরতে পারে না। প্রত্যেকটা মানুষকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
ভারতের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে চান তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করেন। আমাদের সঙ্গে বড় দাদা আর মাস্তানমুখী আচরণ বন্ধ করেন। আমরা আমাদের পায়ের ওপরে দাঁড়াতে চাই। আমরা আমাদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই। আমরা অবশ্যই ভারতকে একটি বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হবে সম্মানের সঙ্গে, আর আমার যে পাওনা আছে সেই পাওয়া বুঝিয়ে দেওয়ার সঙ্গে।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা নদী বেষ্টিত লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার মানুষেরা তিস্তা নদীর পানি বৈষম্যের শিকার হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা বাক স্বাধীনতা পেয়েছি। রংপুরের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে জেগে উঠেছে। এ লক্ষ্যে তিস্তা নদীর পানি চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে ৫ জেলার মানুষকে নিয়ে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তিস্তা পানি নিয়ে বৈষম্যের বিষয়টি গোটা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া হবে।