বরগুনার আমতলী উপজেলার একমাত্র সরকারি মৎস্য হ্যাচারিটি প্রায় ২০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবে গুণগতমানের মাছের রেণু পোনা সংগ্রহ করতে পারছেন না এ উপজেলার অসংখ্য মৎস্য চাষিরা। ফলে দূরদূরান্ত থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক লোকসানের মুখেও পড়ছেন তারা। তবে স্থানীয় মৎস্য চাষিদের সুবিধার্থে হ্যাচারিটি পুনরায় চালু করতে একটি প্রকল্পের আওতায় কথাবার্তা চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য বিভাগ।
বরগুনা জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আমতলী উপজেলায় ১৯৯১ সালে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি মিনি হ্যাচারি নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ে হ্যাচারিটিতে পানি সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাঙ্ক ও মা মাছের পোনা সংরক্ষণের জন্য চারটি পুকুর খনন করা হয়। পরবর্তীতে মৎস্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে ওই বছরই মা-মাছ সংগ্রহ করে রেণু পোনা উৎপাদন শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর হ্যাচারিটি থেকে বিভিন্ন মৎস্য চাষিদেরকে প্রায় ৯০ লাখ পরিমাণ রুই ও কাতলের রেণু পোনা সরবরাহ করা হতো। তবে ২০০৪ সালের দিকে হ্যাচারির ওভারহেড ট্যাঙ্কে পানি তোলার বৈদ্যুতিক পাম্পটি অকেজো হয়ে পড়লে বন্ধ হয়ে যায় রেণু পোনা উৎপাদন। পরবর্তীতে সমস্যা সমাধান করে পুনরায় হ্যাচারিটি চালুর বিষয়ে তেমন আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে বন্ধ হয়ে যাওয়া আমতলীর মিনি মৎস্য হ্যাচারি ঘুরে দেখা যায়, পরিত্যক্ত অবস্থায় জরাজীর্ণভাবে পড়ে আছে মাছের রেণু পোনা উৎপাদনে নির্মিত স্থাপনাগুলো। ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে পানির পাম্প স্থাপন করা ঘরটি। খসে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায় ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা। আর পানি সরবরাহের জন্য বসানো পাম্পটির অবশিষ্ট আছে শুধু কয়েকটি লোহার পাইপ। দীর্ঘ বছর ধরে হ্যাচারিটি বন্ধ থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ ছাড়া হ্যাচারিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাছ সংরক্ষণের জন্য খননকৃত দুটি পুকুরও সম্প্রতি ভরাট করে ফেলেছে আমতলী উপজেলা প্রশাসন। তবে স্থানীয় মৎস্য চাষিদের দাবি পুনরায় সরকারি এ হ্যাচারিটি যদি চালু করার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে একদিকে ভোগান্তি কমবে, এবং হ্যাচারি থেকে গুণগত মানের রেনু পোনা সংগ্রহ করা যাবে।
সাইদুল শিকদার নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মৎস্য হ্যাচারিটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে চাষিরা খুলনা ও যশোর থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করেন। এতে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ ছাড়া দুটি পুকুর ছিল তাও কিছুদিন আগে ভরাট করা হয়েছে। হ্যাচারিটি যদি আবারও চালু করা হয় তাহলে স্থানীয় মৎস্য চাষিদের জন্য উপকার ভালো হবে।
মো. আব্দুল জলিল হাওলাদার নামে স্থানীয় এক মৎস্য নার্সারির উদ্যোক্তা বলেন, দীর্ঘবছর ধরে আমরা আমতলী হ্যাচারি থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে পারছি না। এ কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে খুলনা, বাগেরহাট ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রেণু পোনা সংগ্রহ করতে হয়। তবে দূর থেকে সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের উন্নত জাতের পোনা পেতে অনেক ঘাটতি হয়। যদি আমতলী মৎস্য বিভাগের মাধ্যমে আবারও হ্যাচারিটি চালু করে রেণু পোনা উৎপাদন করা হয় তাহলে সেখান থেকেই আমরা উন্নত জাতের মাছের রেণু সংগ্রহ করতে পারব।
মো. খালিদ নামের আরেক মৎস্য চাষি বলেন, আমরা গত দুই বছর আগে যশোর থেকে মাছের রেণু পোনা কিনে এনেছিলাম। তবে তা বাঁচাতে পারিনি। এমন ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের বড় পরিসরে যে কয়টি মাছের খামার ছিল তা বন্ধ করে ফেলেছি। শুধু একটি হ্যাচারি না থাকার কারণে আমাদের এ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
আমতলী উপজেলার হলদীয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ও মৎস্য চাষি আব্দুস সালাম মোল্লা বলেন, আমতলীতে অসংখ্য মৎস্য চাষি রয়েছে। স্থানীয়ভাবে মৎস্য চাষিদের নার্সারি থেকে আমরা মাছের রেণু পোনা সংগ্রহ করি। তবে তারা দূরদূরন্ত থেকে রেনু সংগ্রহ করায় ওই রেণু পোনা থেকে মাছ চাষে আমরা তেমন ভালো ফালাল পাই না। এর আগে, আমতলীর সরকারি হ্যাচারি থেকে যখন মাছের রেণু পোনা সংগ্রহ করা যেত তখন আমাদের ঠিকই লাভ হতো। আমরা চাই আমতলীর হ্যাচারিটি আবারও চালু করা হোক।
আমতলীর মিনি মৎস্য হ্যাচারিটি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত পরিচায়ক মোখলেছুর রহমান বলেন, হ্যাচারিটির দায়িত্বে মৎস্য কর্মকর্তা থাকলেও দীর্ঘবছর ধরে বন্ধ অবস্থায় আছে। এ কারণে স্থানীয় যেসব মৎস্য চাষি রয়েছেন তাদের দূরদূরন্ত থেকে মাছের রেণু পোনা সংগ্রহ করতে হয়। এতে বিভিন্ন ভোগান্তিসহ মাছের রেণু পোনার গুণগতমান যাচাই-বাছাই করা যায় না এবং পরিবহনেও অনেক বেশি খরচ হয় তাদের।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন বলেন, একটি হ্যাচারি চালু করতে হলে কিছু স্পেশাল স্থাপনার প্রয়োজন হয়। আমতলীতে জায়গার পরিমাণ সীমিত, তবে এখানে ব্যাপক রেণুর চাহিদা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় চাষিদের চাহিদা পূরণ করতে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। হ্যাচারিটি পুনর্নির্মাণ করতে নতুন একটি প্রকল্পের আওতায় আলোচনা চলমান রয়েছে।