কিশোরগঞ্জে প্রেমের কারণে সাত দিন ধরে শিকলবন্দী কিশোরী!

 


কথা ছিল দুজনে মিলে সাজাবো সুখের সংসার। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তোমাকেই শুধু চাইবো। সে কথা আমি রাখতে চাইলেও পালিয়ে বেড়াচ্ছো তুমি। তোমার কারণে আজ আমি শিকল বন্দী জীবন পার করছি। অপরাধ শুধু তোমাকে ভালোবাসা। তোমাকে বিশ্বাস করে আমি আমার সব উজাড় করে দিয়েছি। জেনে গেছে, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই। তোমাকে হারানোর চিন্তা মাথায় আসলে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। সেই অপরাধে সপ্তাহখানেক যাবৎ পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছে পরিবার।

রোববার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে এভাবেই গণমাধ্যমের কাছে নিজের মনের কথাগুলো বলছিলেন এক কিশোরী।

অমানবিক এমনই এক ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া ইউনিয়নের দেওচান্দী গ্রামে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে পায়ে শিকল লাগিয়ে তালাবদ্ধ করে আটকে রাখা হয়েছে ১৫ থেকে ১৬ বছরের এক কিশোরীকে।

জানা যায়, একই ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সরিষাপুর। সেই গ্রামের মৃত এমরানের ছেলে হাইমুল (১৬) এর সঙ্গে প্রায় ৪ বছরের প্রেমের সম্পর্ক ওই কিশোরীর। হাইমুল পেশায় অটোচালক। প্রেমের সম্পর্ক একসময় গড়ায় শারীরিক সম্পর্কে। বিষয়টি জানাজানি হলে লাপাত্তা হয়ে যান প্রেমিক হাইমুল। মানতে না পেরে ঘরের ভেতর আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন ভুক্তভোগী কিশোরী। পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারায় সেই যাত্রায় আত্মহত্যা আটকাতে সক্ষম হন তারা। ওই কিশোরী আত্মহত্যা করতে পারেন সেই ভয়ে পরিবারের সদস্যরা কিশোরীকে পায়ে শিকল দেয়ে তালাবদ্ধ করে রাখেন। কিশোরীর মা নেই। আর বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন। তিনি এখন প্রবাসে থাকেন। ওই কিশোরীর সঙ্গে আছেন শুধু সৎ মা ও দাদী। পরিবারে পুরুষ সদস্য না থাকায় ভুক্তভোগী ওই কিশোরীকে নিয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে।

কিশোরীর সৎ মা জানান, সরিষাপুরের হাইমুলের সঙ্গে চার বছর যাবৎ প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার মেয়ের। তখন ছেলে মেয়েকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত করে। গত ৮ দিন আগে দুজন মিলে এক জায়গায় ঘুরতে যায়। বিষয়টি পরবর্তীতে পরিবারের সবাই জেনে যায়। তখন মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে হাইমুলের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি জানা যায়। পরে ছেলের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিয়ের বিষয়ে কথা বলি। কিন্তু ছেলে আমাকে ফোন দিয়ে মেয়েকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়। ছেলেটাকে অনেক বুঝিয়েছি। তার মেয়ের জীবনটা যেন নষ্ট না হয় সেই চেষ্টা করেছি। প্রয়োজনে আরও সময় নিয়ে হলেও যেন তার মেয়েকে হাইমুল বিয়ে করে সেই অনুরোধও করা হয়। যা চাইবে তা দেওয়া হবে বলেও জানান কিশোরীর মা।

দাদী বলেন, আমার নাতি ওই ছেলের জন্য ফাঁসি নিতে চেয়েছিল। সবসময় আমরা কিভাবে দেখে রাখবো। সেজন্য পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।

ভুক্তভোগী কিশোরী বলেন, আমি হাইমুলকে বুঝিয়েছি। তাকে বলেছি, দেখ আমার কিন্তু কেউ নেই। ছোট সময় মা মারা গেছেন। আমি খুব অসহায় আমাকে কষ্ট দিও না। আমি তাকে প্রথমে বিশ্বাস করিনি। সে আমাকে বলেছে, তাকে বিশ্বাস করতে। কিন্তু এখন সে আমার মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমি হাইমুলকে চাই। তাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা আমি। বিভিন্ন সময় রাতের বেলাও আমার সঙ্গে সে দেখা করেছে। আমাকে কসম দিয়েছিল, কোনদিন আমার হাত ছাড়বে না। আমি তাকে বলেছিলাম, তোমার সমস্যা হলে আমাকে বিয়ে করে রেখে দাও। যখন সময় হবে তখন আমাকে তুলে নিও। সেও আমার সঙ্গে এই কথা দিয়েছে। এখন তার মোবাইল বন্ধ। আর যোগাযোগ করতে পারছি না।

পরে গণমাধ্যমকর্মীরাও অভিযুক্ত হাইমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তবে হাইমুলের চাচা মধু মিয়া বলেন, বিষয়টি জানার পর আমি হাইমুলের সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমাকে জানিয়েছে, ভুক্তভোগী ওই মেয়ের সঙ্গে তার খুব বেশিদিনের সম্পর্ক না। ওকে বলেছিলাম বিয়ে করার জন্য কিন্তু ও বিয়ে করতে রাজি না। মেয়ের পরিবারের সদস্যরাও আমার কাছে এসেছিল। বর্তমানে এভাবেই আছে। বিষয়টি সামাজিক ভাবে মীমাংসা করার চেষ্টা চলছে।

হিলচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ঘটনাটি আমার এলাকার। আমি বিষয়টি জানার পর খোঁজ নিয়েছি। আসলে মেয়েটি ঘরে বাঁধা অবস্থায় আছে। যেন অন্য কোন কিছু না করতে পারে। হাইমুল ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ওই ওয়ার্ডের মেম্বারের সঙ্গেও কথা বলেছি যেন, ছেলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে সামাজিকভাবে বিষয়টি শেষ করা যায়। আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি।

বাজিতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুরাদ হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন